লাকিংমের জন্য ন্যায় বিচারের দাবীতে সোচ্চার থাকি
লাকিংমে র স্মৃতির প্রতি ভালোবাসার প্রদীপ প্রজ্জ্বালন
তারিখ: ১৬ জানুয়ারী, শনিবার, ২০২১
সংসদ ভবনের সম্মুখে, মানিক মিয়া এভিনিউ
প্রিয় সুধিজন, শুভেচ্ছা নিবেন।
লাকিংমে চাকমার কথা আপনাদের অনেকেরই জানা আছে। চৌদ্দ বছর বয়সের এই মেয়েটির লাশ প্রায় চার সপ্তাহ ধরে পড়েছিল কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে। পরে আদালতের নির্দেশে প্রাথমিক তদন্তে র্যাব মেয়েটিকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক বলে নিশ্চিত হয়ে তার মা-বাবার কাছে লাশ হস্তান্তর করে। কেচিং চাকমা ও লালাঅং চাকমার সন্তান লাকিংমের বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শিলখালি গ্রামে।অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েটিকে অপহরণের পর জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও বিয়েতে বাধ্য করা হয়। পরিণতিতে সে একটি মেয়ে শিশুরও জন্ম দেয়। নিজের সন্তান জন্ম নেওয়ার মাত্র ১৩ দিন পর মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুটিও স্বাভাবিক মৃত্যু নয়।এটি হত্যা কিংবা আত্মহত্যার প্ররোচনা।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি অপহৃত হয় লাকিংমে চাকমা। জন্মসনদ অনুযায়ী, অপহৃত হওয়ার দিনটিতে তার বয়স ছিল ১৪ বছর ১০ মাস। আমাদের অনুসন্ধানে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, অপহরণের পর ৮ জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত লাকিংমেকে আশপাশের গ্রামে রাখা হয়। ৯ জানুয়ারি তাকে নিয়ে যাওয়া হয় টেকনাফেরই শাহপরীর দ্বীপে। সেখানে জনৈক কালা মনুর বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল অন্তত দু’দিন। টেকনাফ থানা ন্যূনতম উদ্যোগ নিলে কিশোরী মেয়েটিকে উদ্ধার করতে পারতেন বাবা লালাঅং চাকমা।
এরপর গত ১১ জানুয়ারি তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কুমিল্লায়। এরপর ২১ জানুয়ারি কুমিল্লার আদালতে লাকিংমেকে ধর্মান্তর এবং একটি কাজি অফিসে নিয়ে বিয়েতে বাধ্য করা হয়। টেকনাফের বাহারছড়া মাথাভাঙ্গা এলাকার ইয়াসিন, ইসা, আবুইয়াসহ আরও পাঁচজন লাকিংমেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। লালাঅং তাঁর মেয়ে অপহরণের পর টেকনাফ থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন। তখন কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ওসি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় বরখাস্ত এবং বর্তমানে জেলবন্দি প্রদীপ কুমার দাশ।মামলা নেয়নি পুলিশ।
থানায় মামলা করতে না পেরে ২৭ জানুয়ারি লালাঅং কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন । আদালত থেকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্তের নামে যে অবহেলা তারা করেছেন তা পিবিআই কক্সবাজার ইউনিটের পরিদর্শক ক্যশৈনু মারমার দেওয়া দু’ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন। অপহরণের পর কেটে যায় ১১ মাস। এ সময় মেয়েকে হন্যে হয়ে খুঁজেছেন বাবা। অবশেষে গত ৯ ডিসেম্বর লালাঅং তাঁর মেয়ে লাকিংমের খোঁজ পান। তবে জীবিত নয়, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে তাঁর প্রিয় কন্যার মরদেহ।
এ ঘটনার পর উদ্বিগ্ন শিক্ষক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও আদিবাসী নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধি দল গত ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর সরেজমিনে পরিদর্শনে যান।এদিকে সর্বশেষ র্যাবের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ৪ জানুয়ারি লাকিংমের লাশ তার বাবাকে হস্তান্তরের পর সেদিনই রামুতে সমাহিত করা হয়।তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে নিজ গ্রাম শিলখালির পরিবর্তে লাকিংমেকে রামুতে সমাহিত করতে হয়েছে বলে আমরা জানতে পারি। উপরিউক্ত বিষয়গুলো নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শনে যাওয়া নাগরিক প্রতিনিধিদল গত ৫ জানুয়ারী ২০২১ এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে এবং তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। কিন্তু এতদিন পরও আসামীদের অবাধে ঘুরে বেড়ানো দেখে আমরা গভীরভাবে ভাবিত হচ্ছি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির চলমান প্রবাহে লাকিংমে চাকমার ন্যায় বিচার নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।
অন্যদিকে সরেজমিন পরিদর্শনে যাওয়া নাগরিক প্রতিনিধিদল তাঁদের পর্যবেক্ষণে আতাউল্লাহ এবং তাঁর সহযোগীরা মারাত্মক পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অপরাধ করেছেন বলে চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো হল- ১. অপহরণ, ২. ধর্মান্তরে বাধ্য করা, ৩. অপ্রাপ্ত বয়স্ককে বিয়ে করা, ৪.ধর্ষণ এবং ৫. হত্যা অথবা আত্মহত্যায় প্ররোচনা। তাই আজকের এই আয়োজন থেকে আমরা নিম্নোক্ত দাবিসমূহ তুলে ধরছি।
আমাদের দাবিসমূহ:
১.অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরী লাকিংমে চাকমাকে জোরপূর্বক ধর্মান্তর, বিয়ে, যা ধর্ষণেরই নামান্তর। তাই নিয়মিত মামলা দায়ের করে অনতিবিলম্বে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
২.লাকিংমে আত্মহত্যা করেছে, নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত করে নিশ্চিত হতে হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। আত্মহত্যায় প্ররোচনার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে সেগুলো আমলে নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে।
৩.চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা লাকিংমে চাকমার পরিবারকে যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪.লাকিংমের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৫.ঘটনার প্রথম তদন্তে পিবিআই যে অবহেলা করেছে তার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।
৬.সনদ জালিয়াতি এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক একটি মেয়ের জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও বিয়েতে বাধ্য করার দায়ে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৭. লাকিংমের সন্তানকে আইনানুযায়ী রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নিয়ে শিশুটির যথাযথ ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে হবে
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, ব্লাস্ট, এএলআরডি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন,বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।