যখনই আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে কোন পর্যটন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয় তখনই আদিবাসী, প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ সেই উন্নয়ন কার্যক্রমের বিরোধিতা করে। বাগড়া দেয়। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে সিকদার গ্রুপ ও নিরাপত্তা বাহিনীর কল্যাণ ট্রাস্টের যৌথ প্রয়াসে নির্মাণাধীন বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল ও পর্যটন স্থাপনা প্রকল্পে আদিবাসী, প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ তীব্র বিরোধিতা করছে। এমনিভাবে নিকট অতীতেও সাজেক ভ্যালী, নীলগিরী, নীলাচল, মধুপুর ইকোপার্ক, গজনী অবকাশ যাপন কেন্দ্র, মুরইছড়া ইকোপার্ক ইত্যাদি নির্মাণে আদিবাসীদের অবস্থান ছিল হার্ডলাইনে। এরফলে আদিবাসী মানুষের বিরুদ্ধে একটি মিথ বা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে পড়েছে যে, আদিবাসীরা সবসময়ই উন্নয়ন পর্যটনের বিরোধীতা করে, তাঁরা সরকার ও প্রগতি বিরোধি!
এই মিথ সত্য নাকি মিথ্যা তা যাচাইয়ের আগে তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে আদিবাসী বনাম শাসক গোষ্ঠীর মধ্যকার যে দ্বন্ধ-সংঘাত বিবাদমান সেটিই সামনে আসার কথা, কিন্তু রাষ্ট্র সেই দ্বন্দ্ব সংঘাত মীমাংসা না করে উল্টো চাতুর্যের সাথে সেই দৃশ্য আড়াল করে জোড়সে চাপিয়ে দেয় ‘উন্নয়ন উৎপীড়ন’। তারপরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মিডিয়ার বদৌলতে সেই চিত্র ফুটে উঠে। এখানে প্রথমত ‘আদিবাসীরা কেন পর্যটন উন্নয়নের বিরোধিতা করে’ এই প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
পর্যটনের হটস্পট পাহাড় কিংবা সমতলের আদিবাসী অধ্যুষিত যেসব অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয় সেইসব প্রকল্পে আদিবাসীরা স্পষ্টই তাদের ভবিষৎ দেখতে পায় না। যাঁর ফলে তাঁরা সরাসরি বিরোধিতা করে। কেননা ‘উন্নয়ন’ যদি মানুষের জীবনে তিক্ত অভিজ্ঞতা, বিভীষিকা, উচ্ছেদ, বঞ্চনা, হাহাকার, অনিশ্চিত ভবিষৎ তৈরী করে তবে সেই ‘উন্নয়ন’কে মানুষ কী করে সমর্থন করবে?
জনম দুঃখী আদিবাসীর জীবনে পর্যটন, উন্নয়ন কখনও কোথাও কস্মিনকালেও আশীর্বাদ হয়ে আসেনি, এসেছে শাপে বর হয়ে। আমার দেখা অভিজ্ঞতায় যদি বলি ১৯৯৩ সালে গারো পাহাড় পাদদেশে গারো, কোচ অধ্যুষিত গাজিনি সং (গাজিনি গ্রাম) এ যখন ৯০ একর পাহাড়ী এলাকা নিয়ে অবকাশ যাপন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয় তখন সেখানকার আদিবাসীদের জমি বেদখল হয়ে যায়। উর্বর কৃষি জমিতে কংক্রিটের বাধঁ দিয়ে নির্মাণ করা হয় কৃত্রিম লেক, আদিবাসী বসতি উচ্ছেদ করে স্থাপন করা হয় সুউচ্চ টাওয়ার, পশু-জীবজন্তু প্রদর্শনে মিনি চিড়িয়াখানা। পরে কয়েক বছরের মাথায় মাটি কামড়ে পড়ে থাকা কোচ আদিবাসীদের শেষ কয়েক পরিবারও ভিনদেশীর উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে পার্শ্ববর্তী রাংটিয়া গ্রামে চলে যায়। এ দৃশ্য আমি স্বচক্ষে দেখেছি। এই পর্যটন স্থাপনা নির্মাণের সাথে সাথে আদিবাসী গ্রাম গাজিনিকেও পাল্টে নতুন নাম দেয়া হয় ‘গজনী’। এখন সং গাজিনিকে সবাই ‘গজনী’ নামেই চেনে। এখানেই উন্নয়নের আড়ালে লুকায়িত থাকা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন স্পষ্ট ধরা খায়। গজনী অবকাশ কেন্দ্রের পশ্চিম লেকের ওপারের পাহাড়ে এখনো সুবিশাল বটবৃক্ষের নিচে কোচদের মন্দির আছে। পূজা-পার্বন উৎসবে গাজিনির আশেপাশের কোচেরা সেখানে এসে পূজা, উৎসব করে। সংখ্যালঘু আদিবাসী জীবনের এ এক করুণ ট্র্যাজেডি। যেন দেখার কেউ নেই।
সং গাজিনির মতোই যে সমস্ত আদিবাসী অঞ্চলে পর্যটন উন্নয়ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে সেখানকার স্থানীয় আদিবাসীদের অভিজ্ঞতা মোটামুটি একই। এক অভিন্ন হওয়াটা স্বাভাবিক বৈকি। কেননা প্রচলিত এই উন্নয়ন দর্শনের ধারণা সার্বজনীন নয়। সমাজের বিভিন্ন অবস্থান দেখে দেখার কারণে এই উন্নয়নের চিত্রে রকমফের হয়। আপনি দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে ইংরেজী নাম্বার নয়কে ছয় দেখলে উত্তর গোলার্ধ থেকে আরেকজন ছয় সংখ্যাকে ছয় দেখবে এটাই স্বাভাবিক। এজন্য এই উন্নয়নকে অর্থনীতিক, উন্নয়নকর্মীরা বলেন ‘পক্ষপাতী উন্নয়ন’।
আমাদের দেশে পর্যটন, বিদুৎতায়ন, বিদেশী বিনিয়োগ, কালো পিচের রাস্তা, উচুঁ ভবন স্থাপন মানেই উন্নয়ন এরকম একটি ধারণা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই ধারণা দিয়ে প্রান্তিক ছিন্নমূল মানুষের জীবন, বেঁচে থাকার শেষ সম্বল কেড়ে নেবার আয়োজন চলে এবং তার বৈধ্যতা জাহিরের জন্য ‘উন্নয়ন’কে ব্যবহার করা হয় সাইনবোর্ড হিসেবে। উন্নয়ন চাইলে কিছু বিসর্জন দিতে হবে এমন ভাব আরকি। কিন্ত অর্জন করতে গিয়ে যদি বিসর্জনের পরিমাণ বেড়ে যায় তখন সেই অর্জন দিয়ে কী হবে?
পর্যটন হলে স্থানীয় আদিবাসীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবার সুযোগ থাকবে এমন খোঁড়া যুক্তি প্রায়শ উন্নয়নবাদীরা তুলে ধরেন। এই যুক্তি খাড়ালে আমরা দেখি, পর্যটন উন্নয়নে স্থানীয় আদিবাসীরা কখনোই লাভবান হন না, বরং জায়গা জমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। যে পয়েন্টটা মার্ক করা দরকার, পর্যটনে আদিবাসী মানুষ রিসোর্ট ব্যবসা, দোকানদারী অর্থনীতি বা পরিবহন ব্যবসার সাথে নিজেদের যুক্ত করতে পারেন না, স্বভাব তথা অবস্থানগত নানা কারণে। ফলে আদিবাসীদের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবার যে কল্প নির্ভর ব্যাখা দাঁড় করানো হয় তা বাকওয়াশ বয়ানে পরিণত হয়।
পর্যটন উন্নয়ন হেতু আদিবাসী জমি, খাদ্যের উৎস, সাব-জিস্টেন্স ইকোনমির জায়গা নেয় বাজার অর্থনীতি। পুঁজিবাদীর এই অর্থনীতিতে আদিবাসীরা অভ্যস্থ নয়, এতে তাঁরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারে না। একসময় উন্নয়নের এমন উৎপীড়নে আদিবাসীরা জায়গা জমি ছেড়ে দেশ ত্যাগ করেন। দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়েও হতভাগা কেউ মাইন বিস্ফোরণে মারা যান। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে সাজেক পর্যটন এলাকার গ্রাম প্রধান অনিশ্চিত ভয়ংকর এক ভবিষ্যতের আশঙ্কার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘‘আগে যেখানে ১২০ পরিবার পাংখো, লুসাই জনগোষ্ঠীর মানুষ ছিল এখন সেখানে আছে মাত্র ১০ পরিবার। সামনের দিনে টিকতে পারবো কিনা বলা যায় না।’’
এ প্রসঙ্গেই ব্লগার পাইচিং মং মারমা ‘উন্নয়নের রাজনীতি ও উন্নয়নের আগ্রাসন: প্রসঙ্গ পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শীর্ষক নিবন্ধে বলছেন ‘‘৭১ টিভির তিন বছর আগের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে, খাদ্য সংকটের কারণে গত ৩ বছরে শতাধিক পরিবারের প্রায় পাঁচশ আদিবাসী দেশ ছেড়েছেন।লেখক এবং সমাজকর্মী কংচাই মারমা তাঁর ফেইসবুক নোটে দেশত্যাগী ম্রো আদিবাসীদের কথা তুলে ধরেছেন। সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে খাদ্যাভাব, জীবিকার সংকট, জীবন যাপনের সংকটে তাঁরা দেশত্যাগ করছেন। বোমা নয়, গুলি নয়, উন্নয়ন! উন্নয়নের উৎপীড়নে তাঁরা দেশ ছাড়ছেন’’। চলতি এই উন্নয়নের জ্বালাতন এমন যে, পাহাড়ি মানুষ নিরাপদে ঘরে থাকতেও স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করে না। এই বুঝি কোন পর্যটক এসে উপদ্রুপ করা শুরু করলো!
আদিবাসীরা স্বভাতই প্রকৃতিচারী, নিভৃত, নিরুপদ্রপ জীবনযাপনে অভ্যস্থ। কিন্তু পর্যটন হবার পর তা আর সম্ভব হয়ে উঠে না। ‘‘একসময় বগালেকে বম তরুণীরা একসাথে গোসল করতো। সেসব বন্ধ হয়েছে বহু কাল। তাদের ঘরদোরের পাশে বেজায় ভিড় লেগে থাকে আজকাল। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরাই দায়। বেড়াতে আসা মানুষ বমদের আঙিনায় ঢুকে সেলফিও তুলতে চান। এক মারমা তরুণ ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘পর্যটকদের কাছে আমরা কম বেশি ‘সাফারি পার্ক’ -এর মতোই (প্রথম আলো, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৯)।’’ গবেষক আলতাফ পারভেজের লেখাটি হুবুহ তুলে দিলাম। এতে সামান্য হলেও পর্যটনের উৎপীড়ন বোঝা যাবে।
পর্যটনের আরেকটি জ্বালাতন পাহাড়িদের নিত্য সইতে হয়। উচুঁ পাহাড়ি পথে কোন পাহাড়ি নারী আদি স্বভাবে কোলে শিশু, পিঠে ঝুড়ি ভর্তি ভারী জিনিস বয়ে চলছেন এমন সময়ে পর্যটকের দল সেই পাহাড়ি নারীর উপর হামলে পড়ছেন। সেলফি তুলতে চাইছেন, ছবি তুলতে না করলেও বেহায়ার মতো জোর খাটিয়ে ফটো খিঁচছেন। এমন চিত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন স্পটগুলোতে হরহামেশাই দেখা যায়। এটি কী পাহাড়িদের অবমূল্যায়ন করা নয়? অনেক উন্নত দেশে ফটোগ্রাফি নিয়ে আইন বা নীতিমালা থাকলেও আমাদের দেশে নেই। সেইসব দেশে এভাবে একজনের অমতে যাঁরা ছবি তুলেন তাঁরা হ্যারেচমেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন।
এই যে আদিবাসী জনমানুষ প্রতিনিয়ত পর্যটন উন্নয়নের বিরোধিতা করছেন তবে কী উন্নয়ন কার্যক্রম চালানো যাবে না? যাবে বৈকি! তার আগে আদিবাসী মানুষ কেমন উন্নয়ন চান তা জানা আবশ্যক। আদিবাসী মানুষ সিদ্ধান্ত নিক তাঁরা কেমন উন্নয়ন চান। সেজন্য সরকার-আদিবাসী প্রতিনিধির সংলাপ জরুরি। প্রান্তিক মানুষের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটিয়েও উন্নয়ন করা যায়। পাহাড়ে ফাইভ স্টার হোটেল, মোটেল, পর্যটন, বিনোদন কেন্দ্র পার্ক স্থাপনের নামই উন্নয়ন নয়, রাষ্ট্রকে অসর্বজনীন পক্ষপাতী এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
উন্নয়ন ডি. শিরা, অ্যাক্টিভিস্ট
ই-মেইল:[email protected]