সমগ্র জুম্ম জনগণের মাঝে এই প্রশ্নটি এখন উপস্থিত হয়েছে, এবং এই প্রশ্নটি যথাযথ বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে, “জুম্ম জনগণ কি মরার পরে বাঁচবে নাকি বেঁচে থেকেই মরবে”? পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ কোনটিই বেছে নেবে, আমার মতে এই যেটি মহান, শ্রেষ্ঠ, মহত্ত্ব ও গৌরবের সেটিই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ বেছে নেবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। ইতিহাসের পাতায় যেমনটি স্বর্ণাক্ষরে লিখিত দলিল হিসেবে পৃথিবীর বুকে জীবন্ত থাকবে যুগের পর যুগ ধরে, তেমনটিই করবে পাহাড়ের নিপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত বিপ্লবী জনগণ। আমরা বেঁচে থেকেই মরতে চাই না, আমরা চাই মৃত্যুর পর সগৌরবে বেঁচে থাকতে। আমরা যেকোন শাসকের চাপিয়ে দেওয়া পরাধীনতার জীবন এবং দাসত্বের কারাগারে বন্দী জীবন কখনোই কামনা করি না।
এই পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ জীবনকে একদিন বাঙালি জাতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল, কিন্তু ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শহীদের রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ন্যায় জাতিগত শোষণের আশ্রয় নিয়েছিল বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী, যা মানবতার দুশমন হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের মঞ্চে যুগ যুগ ধরে ঘৃণিত হয়ে থাকবে। জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখেই আমরা বেঁচে থাকতে চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার তথা মানুষের বেঁচে থাকার সামগ্রিক অধিকার নিয়ে পাহাড়ের বুকে বসবাস করতে চাই। যেই অধিকারগুলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পূর্বের সময়কালে চাকমা রাজা তথা আদিবাসী জুম্ম রাজন্যবর্গ এই পার্বত্যাঞ্চলে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করে গেছেন।
এই ভারত উপমহাদেশের প্রায় ৬০০ বছরের মোগল শাসনেও এই অঞ্চলের আদিবাসী জুম্মদের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করতে পারেনি। সেই ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ায় স্বাভাবিক আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে কিভাবে বেঁচে থাকতে চাই? এই প্রশ্ন অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক উপায়ে সঠিক মীমাংসায় যদি পৌঁছাতে না পারি তাহলে সরাসরি অন্য রাস্তা আমাদের ধরতে হবে। অন্য রাস্তা দিয়ে যদি জুম্ম জাতি হাঁটতে না পারে তাহলে বিলুপ্তির অনিবার্য পরিণতি গোটা জাতিকে ভোগ করতে হবে। যেই রাস্তা ধরে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময় ক্লান্তিহীনভাবে হেঁটেছিলেন প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমা নেতৃত্বে ৭০ দশকের পাহাড়ী ছাত্র সমিতি থেকে চলে আসা প্রিয় অগ্রজ বীর সেনানীরা। সেই বীর সেনানীদের বীরত্ব গাঁথা ও প্রদর্শিত পথে চলার রাস্তাগুলোতে তাদের পদচিহ্ন জুম পাহাড়ের দিকে দিকে এখনো জীবন্ত অবস্থায় রয়েছে। সূর্যের মতন এবং জীবন্ত গাছের ন্যায় আলো ও ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন প্রিয় জুম পাহাড়ের তারুণ্যের সঞ্জীবনীকে। আমার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পার্বত্য চট্টগ্রামের এই মহান আত্মবলিদানের বীরত্ব গাঁথা জুম পাহাড়ের প্রজন্ম হতে প্রজন্ম বহমান থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আজ অত্যন্ত নাজুক যা যেকোন সময়ের তুলনায় জটিল আকার ধারণ করেছে, এবং এই জটিলতর পরিস্থিতি যেকোন সময় বিস্ফোরণ হতে পারে। জুম্ম জনগণের মাঝে একবুক হতাশা, দীর্ঘশ্বাস ও প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীর প্রতি তীব্র ঘৃণা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যার ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে এক সময় তুষের আগুন হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমনিতর পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় আমাদের অবশ্যই সমস্যাগুলোকে সবদিক থেকে দেখতে শিখতে হবে, কোন বস্তুর শুধুমাত্র সম্মুখটা দেখতে হবে তাই নয়, তার পিছনটাও দেখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি যেহেতু জটিল হতে জটিলতর হচ্ছে, সেহেতু জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আন্দোলনে আরও অধিকতর কৌশলী হয়ে অগ্রভাগে কদম ফেলতে হবে। কথা আছে নির্দিষ্ট অবস্থায় খারাপ জিনিষ ভাল ফল দিতে পারে, আবার ভাল জিনিষও খারাপ ফল দিতে পারে। চীনের একজন মহা মনীষী দুই হাজার বছরেরও আগে বলেছিলেন, “দুর্ভাগ্যের মধ্যে সৌভাগ্য থাকে, সৌভাগ্যের মধ্যে দুর্ভাগ্য নিহিত থাকে”। এক সময় জাপানীরা চীনের বিরাট বিরাট অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল; চীন দেশের মানুষ একে বলেছিল পরাজয়! কিন্তু চীনের পরাজয়ের মধ্যেই ছিল জয়ের বীজ আর অপরদিকে সাম্রাজ্যবাদী জাপানের জয়ের মধ্যেই ছিল তার পরাজয়ের বীজ। ইতিহাসের বুকে কি এটা সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি? হ্যাঁ, হয়েছিল!
এ বিষয়টি স্মরণীয় এই কারণে যে, অনেক জুম্ম জনগণ এখনো আন্দোলন সংগ্রামে হতাশা প্রকাশ করে বলে থাকেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগত মুসলমান সেটেলার বাঙালি অর্ধেক হয়ে গেছে, জুম্ম জনগণ ৩/৪ ভাগ যেমন- জেএসএস, ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থী, গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ হয়ে গেছে, জুম্মলীগ, জুম্মদল পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়ে গেছে, আমরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছি, এমনটাই হতাশাজনক বাণী অনেকেই গোগ্রাসে গিলে ফেলেন। এধরনের হতাশার বিপরীতে জুম্ম জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে আমাদের সুদৃঢ় করা দরকার। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে, সর্বোপরি জাতীয় অস্তিত্বের বিদ্যমান চরম সংকটের বাস্তবতাকে জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে সক্ষম হলে তা কখনোই অসম্ভব বলে বিবেচনা করা যায় না। জুম্ম জনগণের আন্দোলন সংগ্রামের গোড়া থেকে যেভাবে সকল প্রকার বিভেদকামীতাকে বিচক্ষণতার সাথে মোকাবিলা করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি অটুট রাখা সম্ভব হয়েছে সেই গৌরবময় সফলতা ও অর্জনকে যদি দ্বিধা-বিভক্ত শক্তিগুলো বিবেচনায় রাখে এবং প্রকৃত রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে তা সহজেই অর্জন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অবশ্যই সংকীর্ণ ও ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে সকলকে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে।
আমাদের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে একমুখী করা ছাড়া বিকল্প কোন রাস্তা নেই। অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীকে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে এক মুষ্টিতে আঘাত করতে হবে। তাই, শাসকগোষ্ঠীর অনুগামী বাহিনীর গোলামী না করে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের মঞ্চকে আর দিনদিন কলঙ্কিত না করে, শাসকগোষ্ঠীর পুতুল বাহিনীর মতন ঘৃণ্য জীবনকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এখনই সময় এসেছে সেনা-সমর্থিত গোষ্ঠী তথা রাজাকারের লাঞ্ছনা মুছে ফেলবার। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের মঞ্চে বর্তমানে অনুকূল বাতাবরণ বইছে, যা খারাপ জিনিষও ভাল ফল দিতে পারে, এবং নিজেকে পরিবর্তনের এখনই উপযুক্ত সময়। তাই আহ্বান আমার একার নয়, কয়েকজনেরও নয়, গোটা জুম্ম জাতির বিপ্লবী জনতার এই আহ্বান। অথচ অন্যান্য দেশের নিপীড়িত মানুষের আন্দোলনের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যখন একটু একটু করে স্মরণ করি, এবং অন্তর দিয়ে গভীরভাবে উপলদ্ধি করি, তখন আমাদের জুম্ম জনগণের মধ্যে থেকে একরাশ হতাশা সরে গিয়ে আশায় বুক ভরে উঠে। যুক্তি, বুদ্ধি দিয়ে ইতিহাসের বাঁকগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষণের এই পদ্ধতি হবে বস্তুনিষ্ঠ, কিন্ত কল্পকাহিনী ও মনগড়া বিচার বিশ্লেষণ হলে সবকিছুই তখন বুমেরাং হয়ে যাবে। পাহাড়ের মানুষকে সবসময় আশা পোষণ করা উচিত এই মতে বিশ্বাসী হতে হবে। আমরা পারবোই এই মানসিকতা নিয়ে আমাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন পোর্টাল ও ফেসবুক খুললে চোখে পড়ে এবং আলোচনার প্রধান ইস্যু “তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ” বাঁধবে কিনা, হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারী সরকারের পতনের ঘন্টা বেজে উঠছে কিনা এমনই প্রশ্নের আলোকে পত্রিকাগুলোতে করা হয় ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ। এবিষয়গুলোও আমাদের বস্তুর বাস্তব অবস্থা থেকে দেখতে হবে, এবং তার বিশ্লেষণ করতে হবে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত মানুষ কোনদিনই যুদ্ধের পক্ষে নয়, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ সবসময় শান্তির পক্ষে এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী যদি নিজেই যুদ্ধ বাধাবার জন্য জেদ ধরে, তাহলে আমাদের জুম্ম জনগণের তাতেও ভয় পাওয়া উচিত নয়। প্রথমত আমরা এর বিরুদ্ধে, দ্বিতীয়ত আমরা এটাকে ভয় করি না, এমন সাহস ও মনোবল অটুট রেখেই আমাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে। পৃথিবীর বুকে এক সময় আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই জন্মলাভ করেছিল ২০ কোটি মানুষের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাহলে এমনই ধারাবাহিকতায় চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরও অধিক সংখ্যক নিপীড়িত মানুষের মুক্তির বারতা বেজে উঠেছে ঠিক; এভাবে অনাগত দিনে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যায়, তাহলে আরও বহু কোটি কোটি নিপীড়িত মানুষ শোষণ থেকে মুক্তি পাবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ কি শুধু নিরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবে? বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী যদি মনে করে পাহাড়ের আদিবাসী জুম্ম জনগোষ্ঠীকে আজীবনই শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচার করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের এই ভূমিতে ভগবান-ঈশ্বর কিংবা আল্লাহ তাদরকে পাঠিয়েছে; তাহলে ধরে নিন, এসবের বিরুদ্ধে রুঁখে দাঁড়ানোর সময় ঘনিয়ে আসছে। এরকম হলে পরে এক সময় পরাজয়ের গ্লানি সাথে নিয়ে তাদেরকে ফিরে যেতে হবে। ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী বহুবার পার্বত্য চট্টগ্রামকে আক্রমণ করেছিল এবং বহুবার আমাদের জুম্ম জাতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছিল, কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এক পর্যায়ে জুম্মদের অভিজাত শ্রেণির একটি চরম সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিশ্বাসঘাতকতার ফলে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ ব্রিটিশদের হাতে পরাজিত হয়েছিলাম। তারপরও আমরা গর্বের সহিত বলতে পারি, আমাদের যুদ্ধ বিজয়ের ইতিহাস রয়েছে। আমাদের রয়েছে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনার গৌরবময় ইতিহাস। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ যেকোন মূল্যে পাহাড়ের বুকে মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। জুম্ম জাতির জাতীয় জীবনে বারে বারে সংকট নেমে এসেছিল ঠিক, কিন্তু জাতির দুর্দিনে সংকট মোকাবেলায় অসীম সাহস নিয়ে পাহাড়ের বুকে আমাদের জুম্ম জাতির বীর সেনানীরা এগিয়ে এসেছিল। তাঁদের মেধা, ঘাম, রক্ত ও জীবন দিয়ে গড়ে উঠেছে জুম্ম জাতির সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস যুগের পর যুগ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। উল্লেখ্য, ৭০ দশকে মহান নেতা এম এন লারমার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে গ্রাম পঞ্চায়েত, মহিলা সমিতি, যুব সমিতি ও মিলিশিয়া বাহিনী। শুরু হয়েছিল সরকারের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম। তাঁর নেতৃত্বে পুরো জুম্ম জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে এবং সামরিক বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ মহান নেতার শক্ত পরিচালনায় ও শিক্ষায় শান্তিবাহিনীকে ক্রমান্বয়ে এক শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল মুক্তিবাহিনী হিসেবে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। জনসংহতি সমিতির এই নেতৃত্ব ও সামরিক দক্ষতা সরকারের মনে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল। দেশে-বিদেশে জুম্ম জাতির সংগ্রামের কথা, শান্তিবাহিনীর বীরত্বের কথা প্রচার হয়েছিল। জুম্ম জনগণের অন্তরের গভীরে জনসংহতি সমিতি এভাবে জায়গা করে নিয়েছিল। পাহাড়ের নতুন প্রজন্মকে নিরাপদ ভূমি ও নিরাপদ জীবনধারা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পাহাড়ের বীর সেনানীদের এই ত্যাগ, এই রক্ত, এই বিসর্জন, এই মা-বোনের অশ্রু কখনোই বৃথা যাবে না। শত-হাজারো জুম্ম জনগণের আত্মত্যাগ ও বীর শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। এক মুহুর্তের জন্য হলেও জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থামিয়ে রাখবো না, নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাবোই- এটাই হোক আমাদের শপথ।
আমাদের চলার পথকে কেউ রুদ্ধ করে দিতে পারবে না- যদি আমরা মহান মুক্তির মহান আদর্শকে ধারণ করতে পারি এবং সেটা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারি। জুম্ম জনগণের করুণ পরিণতির জন্য দায়ী হলো এই শাসকশ্রেণির শোষণ-নিপীড়ন। দুঃখ, যন্ত্রণা, অভাব জুম্ম জাতির মানুষগুলোকে যন্ত্রণায় দগ্ধ করেছে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ভূমির উপর অধিকার, বনের উপর অধিকার, জন্মভূমির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের লড়াই কোন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, আমাদের লড়াই সেনাশাসনের বিরুদ্ধে, যে সেনাশাসন অর্ধশতাব্দী সময় ধরে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মাথার উপর জগদ্দল পাথরের মতন চেপে বসে আছে। আমাদের লড়াই কোন বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে নয়, আমাদের লড়াই উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, আমাদের লড়াই শাসকগোষ্ঠীর উগ্র মুসলিম ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, যারা আমাদের জুম্ম জাতিকে বঞ্চিত করে রাখতে চায়, ন্যায্য অধিকার দিতে চায় না।
সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র মৌলবাদ ও ইসলামী সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে আমাদের কন্ঠ প্রতিধ্বণিত হবে পাহাড়ের সর্বাগ্রে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ। ফুরোমোন, কেওক্রাডং ও আলুটিলা পার্বত্য চট্টগ্রামে এই তিন জেলায় তিনটি পাহাড় অত্যন্ত সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। যে পাহাড়গুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ঐক্যের প্রতীক বহন করে চলেছে অনন্তকালের সাক্ষী হয়ে, এবং চেঙে, মেউনী, কাচালং, কর্ণফুলী, শঙ্খ ও মাতামুহুরী এই বহতা নদীগুলোর দুই প্রান্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে শহর-নগর, গড়ে উঠেছে গ্রাম, গড়ে উঠেছে নানান ধরণের ফসলাদির মাঠ প্রান্তর যা জুম্ম জাতীয় জীবনের পদচিহ্ন বহন করে চলেছে যুগের পর যুগ। ভাবলে কষ্ট হয়, এসবগুলো এখন বহিরাগতদের দখলে, ব্যবসা বানিজ্য অর্থনীতির চাকা এখন তাদের হাতে, আমাদের নিজস্ব ভূমি জোরপূর্বক কেড়ে নিয়েছে, আমরা জুম্ম জাতি এখন অসহায় এবং সর্বস্বহারা। এসব ফিরে পাওয়ার জন্য আমাদের প্রতিরোধ সংগ্রামে যাওয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।
আমি সব সময় আশাবাদী, শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে নয়, পৃথিবীর দেশে-দেশে তরুণ ও যুবশক্তি যাদের মধ্যে রয়েছে, “মুখে হাসি-বুকে বল, তেজে ভরা মন”। তারাই একজনের শাহদাত্বরণের সঙ্গে সঙ্গে অন্যজন এসে তাঁর স্থান পূরণ করবে। এই জুম্ম জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরাও ঠিক তেমনিভাবেই জুম্ম জাতির মুক্তির যথার্থ পথের সন্ধান এই জুম্ম তরুণেরা একদিন করে গেছেন। তাঁরা আমাদের কন্ঠে মুক্তির গান ও চোখের জল সৃষ্টি করে দিয়ে প্রজন্ম হতে প্রজন্ম তাঁদের শূণ্যস্থান পূরণ করে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র দিয়ে গেছেন। এই তারুণ্যের শক্তি নিপীড়িত জুম্ম জনগণের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনলে মহান হৃদয়ে এসবের প্রতিকারের জন্য নিশ্চয়ই ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাদের মনে বাস্তব সত্যগুলো উদিত হবে এবং গভীরভাবে উপলদ্ধি করবে, নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ভিক্ষা করে পাওয়া যায় না। কোন লোকই দয়া দেখিয়ে নিপীড়িত মানুষের মুক্তি আনতে পারে না। শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের মুক্তি নিজেকেই আনতে হয়। এসব চিন্তা করে শুধু-শুধু বসে থাকলে অন্ধকারে পথ হাঁটরানোর মতন হবে। মনে রাখতে হবে, মাছ যেমন পানি থেকে আলাদা হয়ে বাঁচতে পারে না, আন্দোলনও তেমনি জুম্ম জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এগিয়ে যেতে পারে না। শাসকগোষ্ঠী হিংস্র আক্রমণ চালিয়ে আমাদের আন্দোলনকে যতই বানচাল করার চেষ্টা করুক; কিন্তু কোনকালেই তা সফল হবে না। যে জাতি একবার আন্দোলন করতে শিখেছে, রক্ত দিতে শিখেছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুঁখে দাঁড়াতে শিখেছে, পৃথিবীর কোন শাসকই সে জাতিকে অধিকার না দিয়ে থাকতে পারেনি। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও ঠিক অধিকার না দিয়ে থাকতে পারবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নবম জাতীয় সম্মেলনে জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার সত্য ভাষণটি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস শেষ করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, “জুম্ম জনগণ সংখ্যায় কম হতে পারে, কিন্তু আমরা আমাদের অধিকারের জন্য মৃত্যুকে আমরা জয় করেছি। আমরা মৃত্যুকে ভয় করি না, আমরা আমাদের অধিকারের জন্য আমরা জীবিত অবস্থায় মৃত থাকতে চাই না। আমরা চাই মানুষের মতো বেঁচে থাকতে, এবং বীরের মত মৃত্যুবরণ করতে। তাই আমাদের অধিকারের জন্য অবশ্যই আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার সংগ্রাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, আমাদের চুক্তি বাস্তবায়নের সংগ্রাম অবশ্যই অবশ্যই এগিয়ে নিতে হবে, এই সংগ্রাম সর্ব পর্যায়ে যখন যে বাস্তবতা দেখা দেবে, সেই বাস্তবতার সাথে জনসংহতি সমিতি সামিল হয়ে জুম্ম জনগণকে সাথে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের যে আন্দোলন, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম সেটাকে এগিয়ে নেবে”।
এখানে অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন, আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা খুবই কঠিন এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও জুম্ম জনগণের নিকট বর্তমান আর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের মধ্যে রয়েছে একটি দূর্গম পথ। শাসকগোষ্ঠী তাবেদার বাহিনী এবং তার ভাড়াটে পুতুল বাহিনীর মতন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে প্রতিরোধ করার জন্য জুম্ম জনতার মুক্তি পাগল বীর সেনানীদের হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করতে হবে। এই দূর্গম পাহাড়-পর্বত পাড়ি দিয়ে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার করার জন্য সকল প্রকার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। জুম্ম জাতির আন্দোলনের পরাজয় মানে আমাদের মৃত্যু! বেঁচে থেকেই মরার মতন হীনতা, লজ্জা, গ্লানি ও লাঞ্ছনার ভার বহন করে জীবনকে দগ্ধ করা আমাদের লক্ষ্য নয়। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য লড়াই করেই কেবল জুম্ম জাতির দুশমন সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল দৈত্য-দানবদের আমরা পরাজিত করতে পারি, এবং চুড়ান্ত বিশ্লেষণে জুম্ম জাতীয় মুক্তি অর্জন করতে পারি। এই মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ়তার সঙ্গে শপথ নিয়ে প্রতিটি জুম্ম জনতা ৭০ দশকের ন্যায় পাহাড়ের বুকে প্রতিরোধ সংগ্রামে সামিল হওয়ার আহ্বান, সময়ের দাবিও তাই! নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মুক্তির আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক।
বাচ্চু চাকমা, সাবেক সভাপতি; পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ