মিডিয়ায় বডি শেমিং বন্ধে ৩১ নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্টের বিবৃতি

মিডিয়ায় বডি শেমিং বন্ধের দাবীতে বিবৃতি দিয়েছে ৩১ নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট। আজ এক বিবৃতিতে তারা এ দাবী জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়, প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও লিঙ্গ সমতা ও বৈষম্যহীনতার লক্ষ্যে যে বৈশ্বিক যাত্রা তা থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে এই বাংলাদেশ। দেশে নারীর প্রতি অবমাননা, নির্যাতন ও বঞ্চনা অপমানের যে করুণ চিত্র আমরা দেখতে পাই, তাতে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কিংবা স্বপ্ন দেখবার সুযোগ নেই। তবুও, এই নিদারুন প্রতিকূলতার ভেতরেও, নারী পুরুষ ও সব লিঙ্গের মানুষের জন্য একটি সমতার পৃথিবী গড়তে এবং বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করছেন এদেশের নারীবাদীরা। এদেশে নারীবাদ আন্দোলন ধীরে এগুলেও বর্তমানে তা জোরালো হয়ে উঠছে। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য নারীর প্রতি সকল অবিচার, অন্যায়, বৈষম্য ও অবমাননা দূর করা।
আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন, গোঁড়ামীপূর্ণ সমাজে মানবিক বোধ প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন দাবী করে বিবৃতিদাতারা আরো বলেন, যে কোনো সমাজ বদলে একটি দেশের গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর প্রতি অবমাননা ও অবিচার দূরীকরণে গণমাধ্যমের প্রগতিশীল চিন্তা ও পদক্ষেপ সবসময়ই জরুরি বলে মনে করেন তারা।
বিবৃতিদাতারা আরো বলেন, বাংলাদেশে নারীবাদ আন্দোলনের সাথে জড়িত কর্মীরা, লক্ষ্য করছি যে, বেশ কিছুকাল ধরেই এদেশের বেশ কিছু মূলধারার গণমাধ্যম নারীর প্রতি অবমাননাকর ফিচার, রিপোর্ট, ফটো ইত্যাদি প্রকাশ করে চলেছে। আমরা আতঙ্কিত হয়ে দেখছি যে, যেখানে ক্রমশ আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে চলবার কথা, সেখানে নানারকম কন্টেন্ট তৈরি ও প্রকাশ হচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যমে, যে কন্টেন্টগুলো সরাসরি নারীর প্রতি চরম অপমান, অবমাননার পক্ষে অরুচিশীল বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। সম্প্রতি লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন হিসেবে খ্যাত ক্যানভাস পত্রিকা ১৭ শতকের কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের লেখা কবিতা ‘স্ত্রীজাতি কথন’কে সামনে রেখে ফটোশ্যুট ও ফিচার প্রকাশ করেছে।
এছাড়া নারীর প্রতি চরম অসম্মানজনক এই কবিতাটিতে বর্ণিত পদ্মিনী, হস্তিনী, চিত্রিণী ও শঙ্খিনী নারী কেমন হবে, তার প্রেজেন্টেশন হয়েছে। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের তৎকালীন সামাজিক ও মানসিক চেতনার প্রেক্ষাপটে লেখা এই চরম পুরুষতান্ত্রিক, নারীবিদ্বেষী, ভোগবাদী কবিতাটিকে নতুন করে কেন সামনে আনা হলো, সেটি নিয়ে ভেবে দেখবার আছে বলে আমরা মনে করি। এর পেছনে কোনো পক্ষের কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখবার রয়েছে। এই একবিংশ শতকে নারীর প্রতি এই চরম রেসিস্ট, বডি শেমিংভিত্তিক পদ্যটিকে মহিমান্বিত করে তুলে ধরবার পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে একটি গণমাধ্যমের এদেশের নারীরা তা জানতে আগ্রহী।
যারা নারীবাদী আন্দোলনে সম্পৃক্ত, তারা আশংকা অনুভব করছি এই ভেবে যে, কোনো একটি অসৎ মহল অসৎ উদ্দেশ্যে নারীর অগ্রযাত্রা, কুপ্রথা ভাঙ্গবার লড়াই ও মাথা উঁচু করে চলবার জন্য অর্জিত সাহস, মনোবল ও আত্মবিশ্বাসকে ভেঙ্গে দিতে তৎপর হয়েছে। নারীর প্রতি এ ধরনের মনোভাব পোষণকারী কবিতাকে নতুন করে সামনে এনে এই পুরুষতান্ত্রিক, ন্যাক্কারজনক মনোভঙ্গি ও চেতনা তোষণকারী গণমাধ্যম- ক্যানভাসের এ ধরনের আচরণের তীব্র প্রতিবাদও জানান নারীবাদী আন্দোলনে সক্রিয় কর্মীরা।
এছাড়া অবিলম্বে ক্যানভাস কর্তৃপক্ষকে এই ফিচার প্রকাশের দায়ে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানো হয় বিবৃতিতে। সেইসাথে ক্যানভাসের অনলাইন সংস্করণ থেকে লেখাটি তুলে নিতে এবং একইসাথে ভবিষ্যতে এ ধরনের সেক্সিস্ট, বডি শেমিংমূলক কন্টেন্ট প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে সতর্ক থাকবারও অনুরোধ জানান বিবৃতিদাতারা।
বিবৃতিদাতারা প্রত্যাশা করেন, নারীর অগ্রযাত্রা, লিঙ্গ সমতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় এদেশের প্রতিটি গণমাধ্যম ভবিষ্যতে আরো প্রগতিশীল ও সংবেদনশীল আচরণ করবে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেন, সুপ্রীতি ধর, শারমিন শামস্, কাবেরী গায়েন, স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, ফারহানা হাফিজ, কাশফিয়া ফিরোজ, আফসানা কিশোয়ার লোচন, তাসলিমা মিজি, নাহিদ সুলতানা, দিলশানা পারুল, গীতি আরা নাসরিন, প্রমা ইসরাত, লাকী আক্তার, অপরাজিতা সঙ্গীতা, মাহা মির্জা, ইশরাত জাহান ঊর্মি, নাহিদ আক্তার, কানিজ আকলিমা সুলতানা, ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী, শাশ্বতী বিপ্লব, জান্নাতুন নাঈম প্রীতি, নাহিদা আক্তার, অরণি আঞ্জুম, ফাহমিদা হানিফ ইলা
,মেহেরুন নূর রহমান, ক্যামেলিয়া আলম, হাবিবা রহমান, মিতি সানজানা, বীথি সপ্তর্ষী, শাহাজাদী বেগম, মারজিয়া প্রভা প্রমুখ।